(১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ ; ১২ কার্তিক ১২৭৩ বঙ্গাব্দ – ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ ; ১২ আষাঢ় ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) একজন খ্যাতনামা বাঙালি শিশুসাহিত্যিক । প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর বইগুলি ছোটদের মনোরঞ্জন করে আসছে ।
প্রথম জীবনঃ
চব্বিশ পরগণার নেত্রাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর আদি নিবাস যশোহর । তাঁর পিতার নাম নন্দলাল সরকার । নন্দলাল সরকার যশোরের একটি দরিদ্র কায়স্থ পরিবারের মানুষ ছিলেন । তিনি পরবর্তী কালে খুলনার জয়নগরে থাকতে আরম্ভ করেন । বিখ্যাত চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ নীলরতন সরকার যোগীন্দ্রনাথ সরকারের দাদা । যোগীন্দ্রনাথ সরকার ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন । দেওঘর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন । কিন্তু তিনি নিজের প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নি ।
কর্মজীবন ও সাহিত্যপ্রতিভাঃ
সিটি কলেজিয়েট স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতে আরম্ভ করেন মাত্র পনের টাকা বেতনে। এ সময় থেকেই তিনি শিশু সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন এবং শিশুসাহিত্য রচনা আরম্ভ করেন । আজগুবী ছড়া রচনায় তিনি খুব দক্ষ ছিলেন । তাঁর সঙ্কলিত বই হাসি ও খেলা ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় । তিনি সখা, সখী, মুকুল, বালকবন্ধু, বালক, সন্দেশ প্রভৃতি ছোটদের পত্রিকায় লিখতেন । তিনি মুকুল পত্রিকাটি সম্পাদনাও করেছিলেন।
তিনি ছবির সাহায্য অক্ষর চেনাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন । তাঁর কবিতাগুলির সাথে সুন্দর ছবি থাকত যা ছোটদের মনে এক কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করত । ছোটদের জন্য লেখা বিদেশী উদ্ভট ছন্দ ও ছড়ার অনুসরনে তিনি হাসি রাশি নামে একটি সচিত্র বই প্রকাশ করেন । এর সাথে সাথেই ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সংগৃহিত খুকুমনির ছড়া প্রকাশিত হয় । তাঁর রচিত হাসিখুসি (১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত) বইটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল । তাঁর রচিত ও সঙ্কলিত ৩০টি ছোটদের গল্প ও ছড়ার বইয়ের মধ্যে ছড়া ও ছবি, রাঙাছবি, হাসির গল্প, পশুপক্ষী, বনে জঙ্গলে, গল্পসঞ্চয়, শিশু চয়নিকা হিজিবিজি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । ছোটদের উপযোগী ২১টি পৌরানিক বই এবং জ্ঞানমুকুল, সাহিত্য, চারুপাঠ, শিক্ষাসঞ্চয় প্রভৃতি ১৩-১৪টি স্কুলপাঠ্য বই তিনি রচনা করেছিলেন । ৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বন্দেমাতরম্ বলে একটি জাতীয় সঙ্গীত সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ।
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সিটি বুক সোসাইটি নামে প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন। এই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির প্রথম বই ছেলেদের রামায়ন প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন । কিন্তু তবুও তিনি রচনা ও প্রকাশনার কাজ করে গিয়েছিলেন।
যোগীন্দ্রনাথ সরকার এর ৬টি কবিতা প্রকাশিত হল।
১। হারাধনের দশটি ছেলে
হারাধনের দশটি ছেল
ঘোরে পাড়াময়,
একটি কোথা হারিয়ে গেল
রইল বাকি নয়।
হারাধনের নয়টি ছেলে
কাটতে গেল কাঠ,
একটি কেটে দু’খান হল
রইল বাকি আট।
হারাধনের আটটি ছেলে
বসলো খেতে ভাত,
একটির পেট ফেটে গেল
রইল বাকি সাত।
হারাধনের সাতটি ছেলে
গেল জলাশয়,
একটি সেথা ডুবে ম’ল
রইল বাকি ছয়।
হারাধনের ছয়টি ছেলে
চ’ড়তে গেল গাছ,
একটি ম’ল পিছলে পড়ে
রইল বাকি পাঁচ।
হারাধনের পাঁচটি ছেলে
গেল বনের ধার,
একটি গেল বাঘের পেটে
রইল বাকি চার।
হারাধনের চারটি ছেলে
নাচে ধিন ধিন,
একটি ম’ল আছাড় খেয়ে
রইল বাকি তিন।
হারাধনের তিনটি ছেলে
ধরতে গেল রুই,
একটি খেলো বোয়াল মাছে
রইল বাকি দুই।
হারাধনের দুইটি ছেলে
মারতে গেল ভেক,
একটি ম’ল সাপের বিষে
রইল বাকি এক।
হারাধনের একটি ছেলে
কাঁদে ভেউ ভেউ,
মনের দুঃখে বনে গেল
রইল না আর কেউ।
২। প্রার্থনা সঙ্গীত
ছোটো শিশু মোরা তোমার করুণা হৃদয়ে মাগিয়া লব
জগতের কাজে জগতের মাঝে আপনা ভুলিয়া রব।
ছোটো তারা হাসে আকাশের গায়ে ছোটো ফুল ফুটে গাছে;
ছোটো বটে তবু তোমার জগতে আমাদেরো কাজ আছে।
দাও তবে প্রভু হেন শুভমতি প্রাণে দাও নব আশা;
জগত মাঝারে যেন সবাকারে দিতে পারি ভালবাসা।
সুখে দুখে শোকে অপরের লাগি যেন এ জীবন ধরি;
অশ্রু মুছায়ে বেদনা ঘুচায়ে জীবন সফল করি।
৩। কাকাতুয়া
কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুমণি,
সোনার ঘড়ি কি বলিছে, বল দেখি শুনি ?
বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্,
যা কিছু করিতে আছে, করে ফেল ঠিক।
সময় চলিয়া যায়-
নদীর স্রোতের প্রায়,
যে জন না বুঝে, তারে ধিক্ শত ধিক।”
বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্।”
কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুধন,
অন্য কোন কথা ঘড়ি বলে কি কখন ?
মাঝে মাঝে বল ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্,
মানুষ হইয়ে যেন হয়ো না ক সঙ।
ফিটফিটে বাবু হলে,
ভেবেছ কি লবে কোলে ?
পলাশে কে ভালবাসে দেখে রাঙা রঙ্।”
মাঝে মাঝে বলে ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্।”
৪। মজার দেশ
এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো !
আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;
ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়, নেংটি-ইঁদুর দেখে;
ছেলেরা খায় ‘ক্যাস্টর-অয়েল’ -রসগোল্লা রেখে !
মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো;
অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া লোকের পিঠে চড়ে !
ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই, উড়তে থাকে ছেলে;
বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে, মাছেরা ছিপ্ ফেলে !
জিলিপি সে তেড়ে এসে, কামড় দিতে চায়;
কচুরি আর রসগোল্লা ছেলে ধরে খায় !
পায়ে ছাতি দিয়ে লোকে হাতে হেঁটে চলে !
ডাঙ্গায় ভাসে নৌকা-জাহাজ, গাড়ি ছোটে জলে !
মজার দেশের মজার কথা বলবো কত আর;
চোখ খুললে যায় না দেখা মুদলে পরিষ্কার !
৫। কাজের ছেলে
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল,চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;
ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়,”
” ছিঁড়ে দেবে চুল।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
বাহবা বাহবা – ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ!
দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।
ওই তো ওখানে ঘুরি ধরে টানে, ঘোষদের ননী;
আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি!
দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ,
সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!
এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যত কিছু পাই;
মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!
দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,
চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।
৫। তোতা পাখি
আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মউ,
কথা কও না কেন বউ ?
কথা কব কী ছলে,
কথা কইতে গা জ্বলে !
Share This Article